শনিবার, ২ মে, ২০২০

মহাদেব সাহা

এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না


এক কোটি বছর হয় তোকাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার হবো ভরা দামোদর
কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।

মন ভালো নেই


বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস


কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি
অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল
আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে
কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস
আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!

একবার ভালোবেসে দেখো


তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
এই মুখে কবিতা ফুটবে না,
এই কণ্ঠ আবৃতি করবে না কোনো প্রিয় পঙ্‌ক্তিমালা
তাহলে শুকিয়ে যাবে সব আবেগের নদী।
আমি আর পারবো না লিখতে তাহলে
...অনবদ্য একটি চরণ, একটিও ইমেজ হবে না রচিত,
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো তবে
কবিতার পান্ডুলিপি জুড়ে দেখা দেবে ঘুরে ঘুরে অনাবৃষ্টি, খরা।
তুমি যদি না তাকাও এই চোখ দেখবে না কিছু
উজ্জ্বল আলোর ভোর ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাবে,
সন্ধ্যাতারা মনে হবে মৃত নিষ্পলক চোখ
যদি ফিরে না তাকাও মর্মে আর পল্লবিত হবে না কবিতা।
তুমি যদি না দাও চুম্বন এই মুখে ফুটবে না ভাষা
মরা গাঙে জাগবে না ঢেউ, দুই তীরে প্রাণের স্পন্দন,
হবে না শস্যের মাঠে শ্রাবণের ব্যাপক বর্ষণ
হৃদয়ে হৃদয়ে আর অঙ্কুরিত হবে না কবিতা, বাজবে না গান।
তুমি যদি আমাকে না ভালোবাসো আর
প্রকৃতই আমি আগের মতন পারবো না লিখতে কবিতা
আমার আঙুলে আর খেলবে না জাদুর ঝিলিক,
এই শাদা পৃষ্ঠা জুড়ে ফুটবে না জুঁই আর চাঁপা।
একবার ভালোবেসে দেখো, একবার কাছে ডেকে দেখো
আবার আগের মতো কীভাবে ফুটাই এক লক্ষ একটি গোলাপ
অনায়াসে কীভাবে আবার অনুভূতি করি সঞ্চারিত,
একবার ভালোসেবে দেখো আবার কীভাবে লিখি দুহাতে কবিতা।

একা হয়ে যাও


একা হয়ে যাও, নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
ঠিক দুঃখমগ্ন অসহায় কয়েদীর মতো
নির্জন নদীর মতো,
তুমি আরো পৃথক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও
স্বাধীন স্বতন্ত্র হয়ে যাও
খণ্ড খণ্ড ইওরোপের মানচিত্রের মতো;
একা হয়ে যাও সব সঙ্গ থেকে, উন্মাদনা থেকে
আকাশের সর্বশেষ উদাস পাখির মতো,
নির্জন নিস্তব্ধ মৌন পাহাড়ের মতো
একা হয়ে যাও।
এতো দূরে যাও যাতে কারো ডাক
না পৌঁছে সেখানে
অথবা তোমার ডাক কেউ শুনতে না পায় কখনো,
সেই জনশূন্য নিঃশব্দ দ্বীপের মতো,
নিজের ছায়ার মতো, পদচিহ্নের মতো,
শূন্যতার মতো একা হয়ে যাও।
একা হয়ে যাও এই দীর্ঘশ্বাসের মতো

একা হয়ে যাও।
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প


অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প, আমি তাকে
দুঃখভরা নকশীকাঁথার মতো আমার শরীরে
করেছি সেলাই,
বড়োই যাতনাময় তবু তার নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে আমি
বুঝেছি কেমন এই প্রবাহিত তোমাদের অটুট জীবন
চারধারে, কেমন সুস্থতা
তার মাঝে ক্রমাগত অন্তঃসারশূন্যতার কী গভীর ধস ও ফাটল!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প তার কাছে থেকেই তো আমি
প্রথম শিখেছি তোমার মুখের সাথে গোলাপের কোথায় অমিল
কিংবা এই চলচ্ছক্তিহীনতার মধ্যে কী প্রখর অন্তহীন ধাবমান আমি
আর সিরিঞ্জের রক্তিম ওষুধই কখনো কখনো
কীভাবে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি হয়;
অসুস্থতা আমাকে দিয়েছো গাঢ় অবিমিশ্র এ কোন চেতনা
যতোই তাকাই চোখ মেলে মনে হয়
ওষুধের একেকটি মৃদু ফোঁটা স্মৃতির ভিতরে রাত্রিদিন
ঝরে কোন বিরল শিশির
শুভ্র নার্স যাকে আমি চিরকাল ভেবেছি শুশ্রূষা
মানুষের ক্ষত ও আহত দেহময় উদ্বেলিত কোমল বর্ষণ
বলে চিনি,
অসুস্থতা তাই তারও কণ্ঠে আমি শুনেছি কোরাস
আমার সকল ঘরময় কখনো দেখেছি তাকে অপেরার মতন
উদ্দাম
এলায়িত ভঙ্গি আর নৃত্যপরায়ণ-
না হলে তাকেই বুকে নিয়ে
কীভাবে এমন আছি দীর্ঘ রাত্রি মগ্ন ও মোহিত
কখনো কখনো এই অসুস্থতাকে মনে হয় প্রিয়তমা প্রেমিকার
চেয়ে আরো বেশি
মনে হয় অনুরক্ত বুঝি কোনো লাজুক তরুণী সে যে
খুব সন্তর্পণে শান্তধীর কিংবা দ্বিধায় আমার শরীরে
তার অলৌকিক স্পর্শ রেখে যায়
এই অসুস্থতা আমাকে দিয়েছে তার নগ্নদেহ, নগ্ন শিহরন
আর তার ব্যাকুলতাময় ঊরু, জঙ্ঘা, স্তন ও শোণিত।
তার দিকে চেয়ে দেখি আমার সম্মুখে
বয়ে যায় কল্লোলিত জীবনদেবতা
আমার সামান্য এই ছিটেফোটা পরমায়ুটুকু কেবল তারই তো দেখি
করুণাধারায় সিক্ত
আমি এই অসুস্থতা তোমাকে পেয়েই কতো যে না-পাওয়াগুলি সহজে ভুলেছি!
তোমার ট্রান্সপেরেন্ট উদার চক্ষুদ্বয়ে দেখা যায়
প্রজ্জ্বলিত ঐশ্বরিক মেধা
তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি তাই মনে মনে ভাবি
তুমি কি মৃত্যুর কাছ থেকে এই সূর্যাস্তের ছায়া, মুগ্ধ টিপ
আর এই সূক্ষ্ম শিল্পের কাজ-করা বিদায়খচিত সুবর্ণপদক
এনেছো আমার জন্য?
যার একদিকে উদাত্ত আহ্বান আর
অন্যদিকে গাঢ় বিস্মরণ!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প আমি জানি
তোমার একটি তুচ্ছ ব্রণের দাগও এতো বেশি চেনা
আমার আত্মাকে যতো শুদ্ধ হতে বলি, বলি বীজন জড়তামুক্ত হও
তার মুখ ততো নৈঃশব্দ্যের দিকে ঘুরে যায়
আর সেই অস্পষ্ট বিলীয়মান কন্ঠস্বরে যেন মনে হয় শুনি
আমার এ রুগ্নতার ভিতর দিয়েই সভ্যতা ও ইতিহাসই
চায় আজ মৌলিক শুশ্রূষা!

যেতে যেতে অরণ্যকে বলি

এমনও অরণ্য তাকে উদ্দাম মর্মর মূর্তি ধরে নেয়া যায়,
বাতাসের অতি দম্ভ বৃক্ষের সমান উঁচু মেঘ, আরো উঁচু
অরণ্যের সীমা
এও শুধু অরণ্যেরই শোভা পায় এতো উঁচু এমন বিশাল
তাই তো মর্মরমূর্তি অরণ্যকে নিঃশব্দ প্রস্তর বলে ভ্রম হয়, মনে হয়
এ নৈঃশব্দ্য প্রস্তরেরই প্রাণ।
অরণ্যও অনেকাংশে জলেরই মতন আস্থাবান অথবা এ জঙ্গমতা
মানুষেরই মতো জন্মগত
মানুষেরই মতো এই স্থিতিগ্রাহ্য পার্থিবতা অরণ্যকে দেখে
মনে হয়
চতুর্দিকে হাত তুলে আমাদেরই আদি কোনো পিতা কোনো
আদিম পুরুষ
রয়েছেন সম্পূর্ণ স্বাধীন সমাসীন, তারই কায়া
এজন্যই অরণ্যকে অনেকাংশে পার্থিব মানুষ যেন লাগে
কখনো কখনো
তাহার ভিতরে বসে দুঃখের গভীর চলাফেরা দীর্ঘ করুণ নিঃশ্বাস
টের পাই
এমন নিশ্চিত ব্যস্ত এতো শব্দহীন এমন নির্জন কোলাহল, ঘুমিয়ে
পড়ার শব্দ
পাথরেরও ঘুম পায়, অরণ্যেরও অবসাদ লাগে,
বৃক্ষের উলঙ্গ মূর্তি আরো গূঢ় অধিক সংযম
আরো খাদ্য পানীয়ের টান এই অবিচ্ছিন্ন বিশুদ্ধ যৌনতা
যা কিনা স্বভাবে বদ্ধ অতি গূঢ় সুদৃঢ় যৌবন, মনে হয়
অরণ্যেতে আছে,
অরণ্যের অধিক অরণ্য সেও হয়তোবা একদিন সৃষ্টি হয়ে যাবে
কিংবা তাও নির্মাণ হয়েই আছে মানুষের সভ্যতার
স্বপ্নের ভিতর
সেই তো প্রস্তর, সেই তাম্র, প্রস্তর যুগের অস্ত্র,
অরণ্য প্রস্তরময়, অরণ্যও আমাদের লোক, তাকেও এভাবে চিনি
মাথায় জড়ানো সাপ পাগড়ির মতোই শাদামাঠা
কখনো পশ্চাৎ থেকে দেখে একান্তই ভিন্ন কেউ এসেছেন
তাও মনে হতে পারে,
আমি জানি আমি এই অরণ্যের খুব বেশি কিছুই জানি না
যতোখানি মানুষেরও জানি নিশ্চিতই অরণ্যেরও ততোটুকু
মাত্র জানা যায়
প্রকৃতই অরণ্য কি অধিক হৃদয়গম্য, পারি, ততোটুকু পারি
অধিক পারি না, ইহার অধিক কোনো কিছুই পারি না।
অরণ্য কি একদিন মানুষেরই মূর্তি ফিরে পবে, এমন
শোকার্ত হবে, দুঃখশীল হবে তার মন
অরণ্যের মনুষ্য স্বভাব মানুষের অরণ্য প্রকৃতি এও কি সম্ভব
অর্থাৎ যা অরণ্য ও আমাদের উভয়েরই সমান অংশে ভাগ!
এই দেখে অরণ্যের নিকট আত্মীয় কেউ অথবা প্রস্তর
আরো মৌন ম্লান হয়ে যাবে
যেতে যেতে ইচ্ছে করে অরণ্যকে একদিন একথা শুধাই,
চলে যেতে যেতে।