শনিবার, ২ মে, ২০২০

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

উটপাখি

আমার কথা কি শুনতে পাও না তুমি?
কেন মুখ গুঁজে আছো তবে মিছে ছলে?
কোথায় লুকোবে? ধু-ধু করে মরুভূমি;
ক্ষ’য়ে-ক্ষ’য়ে ছায়া ম’রে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ।
নিষাদের মন মায়ামৃগে ম’জে নেই;
তুমি বিনা তার সমুহ সর্বনাশ।
কোথায় পালাবে? ছুটবে বা আর কত?
উদাসীন বালি ঢাকবে না পদরেখা।
প্রাকপুরাণিক বাল্যবন্ধু যত
বিগত সবাই, তুমি অসহায় একা।
ফাটা ডিমে আর তা দিয়ে কী ফল পাবে?
মনস্তাপেও লাগবে না ওতে জোড়া।
অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?
কেবল শূণ্যে চলবে না আগাগোড়া।
তার চেয়ে আজ আমার যুক্তি মানো,
সিকতাসাগরে সাধের তরণী হও;
মরুদ্বীপের খবর তুমিই জানো,
তুমি তো কখনো বিপদপ্রাজ্ঞ নও।
নব সংসার পাতি গে আবার, চলো
যে-কোনো নিভৃত কণ্টকাবৃত বনে।
মিলবে সেখানে অনন্ত নোনা জলও,
খসবে খেজুর মাটির আকর্শনে।
ল্পলতার বেড়ার আড়ালে সেথা
গ’ড়ে তুলবো না লোহার চিড়িয়াখানা;
ডেকে আনবো না হাজার হাজার ক্রেতা
ছাঁটতে তোমার অনাবশ্যক ডানা।
ভূমিতে ছড়ালে অকারি পালকগুলি
শ্রমণশোভন বীজন বানাবো তাতে;
উধাও তাহার উড্ডীন পদধূলি
পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজবো না অমারাতে।
তোমার নিবিদে বাজাবো না ঝুমঝুমি,
নির্বোধ লোভে যাবে না ভাবনা মিশে ;
সে-পাড়াজুড়ানো বুলবুলি নও তুমি
বর্গীর ধান খায় সে উনতিরিশে।
আমি জানি এই ধ্বংসের দায়ভাগে
আমরা দুজনে সমান অংশিদার
অপরে পাওনা আদায় করেছে আগে
আমাদের 'পরে দেনা শোধবার ভার
তাই অসহ্য লাগে ও-আত্মরতি।
অন্ধ হ'লে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আমাকে এডিয়ে বাডাও নিজেরই ক্ষতি
ভ্রান্তিবিলাস সাজেনা দুর্বিপাকে।
অতএব এসো আমরা সন্ধি ক'রে
প্রত্যুপকারে বিরোধী স্বার্থ সাধি
তুমি নিয়ে চল আমাকে লোকোত্তরে
তোমাকে বন্ধু আমি লোকায়তে বাঁধি।

অপচয়
প্রেয়সী, আছে কি মনে সে-প্রথম বাঙ্‌ময় রজনী,
ফেনিল মদিরা-মত্ত জনতার উল্বণ উল্লাস,
বাঁশির বর্বর কান্না,মৃদঙ্গের আদিম উচ্ছ্বাস,
অন্তরের অন্ধকারে অনঙ্গের লঘু পদধ্বনি?
আছে কি স্মরনে,সখী, উৎসবের উগ্র উন্মাদনা,
করদ্বয়ে পরিপ্লুতি, চারি চক্ষে প্রগল্‌ভ বিস্ময়,
শুন্য পথে দুটি যাত্রী, সহসা লজ্জার পরাজয়,
প্রতিজ্ঞার বহুলতা,আশ্লেষের যুগ্ম প্রবর্তনা?
সে-শুদ্ধ চৈতন্য, হায়, বৃথা তর্কে আজি দিশাহারা,
বন্ধ্য স্পর্শে পরিণত স্বপ্নপ্রসূ সে-গাঢ় চুম্বন;
ভ্রাম্যমাণ আলেয়ারে ভেবেছিল বুঝি ধ্রুবতারা,
অকূল পাথারে তাই মগ্নতরী আমার যৌবন।।
মরে না দুরাশা তবু; মনে হয় এ-নিঃস্ব জগতে
এতখানি অপচয় ঘটাবে না বিধি কোনও মতে।।

শাশ্বতী

শ্রান্ত বরষা, অবেলার অবসরে,
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলো-ছায়া।
আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে ;
হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি :
মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে,
মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।
কুহেলীকলুষ, দীর্ঘ দিনের সীমা
এখনই হারাবে কৌমুদীজাগরে যে ;
বিরহবিজন ধৈর্যের ধূসরিমা
রঞ্জিত হবে দলিত শেফালি শেজে।
মিলনোত্সবে সেও তো পড়েনি বাকী,
নবান্নে তার আসন রয়েছে পাতা :
পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।

একদা এমনই বাদলশেষের রাতে—
মনে হয় যেন শত জনমের আগে—
সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;
সে-দিনও এমনই ফসলবিলাসী হাওয়া
মেতেছিল তার চিকুরের পাকা ধানে ;
অনাদি যুগের যত চাওয়া, যত পাওয়া
খুঁজেছিল তার আনত দিঠির মানে।
একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষে দাঁড়ালো সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি ;
একটি পণের অমিত প্রগলভতা
মর্ত্যে আনিল ধ্রুবতারকারে ধ’রে
একটি স্মৃতির মানুষী দুর্বলতা
প্রলয়ের পথ ছেড়ে দিল অকাতরে।।

সন্ধিলগ্ন ফিরেছে সগৌরবে ;
অধরা আবার ডাকে সুধাসংকেতে,
মদমুকুলিত তারই দেহসৌরভে
অনামা কুসুম অজানায় ওঠে মেতে।
ভরা নদী তার আবেগের প্রতিনিধি,
অবাধ সাগরে উধাও অগাধ থেকে ;
অমল আকাশে মুকুরিত তার হৃদি
স্বাতি মণিময় তারই প্রত্যভিষেকে।
স্বপ্নালু নিশা নীল তার আঁখি-সম ;
সে-রোমরাজির কোমলতা ঘাসে-ঘাসে ;
পুনরাবৃত্ত রসনায় প্রিয়তম ;
কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।
স্মৃতিপিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা :
সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ।।