বুধবার, ৬ মে, ২০২০

দাউদ হায়দার

জন্মই আমার আজন্ম পাপ
জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী
নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো
ভাংগাচোরা চেহারার হদিস
ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল-
অর্থাৎ আমার নিবাস।
ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও-
আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।
নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ-
যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।
শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার
যারা আমাকে অপারেশন করবে?
পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়ি টাকায় একসের চাল ও অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?
আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি
ঘৃণা আমি পাপী
এরা কেন জন্ম নেয়?
এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ।
মরণ এসে নিয়ে যাক, নিয়ে যাক
লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর?
-বলে
প্রাসাদ প্রেমিকেরা
আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!
আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

মিছিলে তোমার মুখ
মিছিলে তোমার মুখ ছিলো সেদিনের রক্তগঙ্গা রাজপথে
গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে অবশেষে এইখানে এসে কোন মতে
বাঁধলে কঠিন বুক পরম সাহসে; হৃদয়ে আশা দোলে; যেন সব
সম্রাজ্ঞী স্বপন
অথবা বিধাতার স্বর্গীয় শান্তি খোঁজো রাত্রিদিন এই দারুণ মিছিলে। কখন
যে পাপময় বাতাস বয়ে গেল গাছের ডালে; একটু চোখ তুলে দেখলেও
না তুমি–
বরং বললে; “এখানে নিবিড় ভালবাসা আছে অথচ কি যেন নেই—
হায় আমার বাংলা আমার জন্মভুমি!”
—বলে সেই যে হারিয়ে গেলে ফিরে তাকালেও না আর–
জানিনা একি অপার মমতা যে হৃদয়ে তোমার!

একদিন কেউ কাউকে চিনবে না


সবই চলে যায় সবই চলে যাবে একদিন
তবু কেউ কারও মুখ দেখবো না সঠিক
অস্পষ্ট ভালবাসা বরং থেকে যাবে ইতস্ততঃ
আজীবন ইচ্ছেগুলো ভেসে যাবে বাতাসে নীলিমায়
চোখে চোখে চোখ রাখলে কেউ কাউকে চিনবো না
ভুল করে পাশাপাশি হেঁটে গেলে কেউ কাউকে দেখবো না –
একদিন শরীরে শরীরে মিশে যাবো
একদিন জীবন সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো
একদিন মিছিল থেকে চলে যাবো মরণ ভবনে
একদিন ডেকে ডেকে চলে যাবে অলীক ঠিকানায়
একদিন নির্ভুল নিয়মে দাঁড়াবো মুখোমুখী
একদিন আমি তুমি চলে যাবো কালের আঙিনায়
একদিন তবু কেউ কাউকে চিনবো না!

আমার পিতাকে

মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমি এক নির্বোধ বালক
যেন। আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না কোনো কালেই; জানেন
তিনিই শুধু। যার কোলে-পিঠে মানুষ আজীবন; তিনি এই পৃথিবী-লোক
ছেড়ে এখন কোথায় যে ছিটকে পড়ে আছেন
তা বলতেও পারিনা সহসা ৷ অথচ বাড়িতে তাকে
নিয়ে আমাদের ভাবনার অন্ত নেই। এদিকে গতায়ু হবেন
যিনি আজকাল কিংবা মাসাধিকাল পরে; আপাতত তাকে
নিয়ে কেউ-ই ঘামায় না মাথা। বুড়োটে শরীর তার
ভীষণ উত্তেজিত হাতের তুড়িতে একদা নিমেষে উধাও হতো সব। তিনি
আজ বিছানায় একা একা শুয়ে ভাবেন আল্লার
আরশ। মুমূর্ষু পিতার সংসারে আমিই বড় ছেলে। সব দায়িত্ব আমাকে
কাঁধে তুলে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরে পালাতে চান যিনি
তাকেই বাঁচাতে চাই আপ্রাণ চেষ্টায়; আমার পিতাকে।

তুমিই আমার প্রেমিকা

তুমিই আমার প্রেমিকা। যেহেতু
তুমিই আমাকে প্রথম ভালবাসা শেখালে
কি করে ভালবাসতে হয়।
একদিন দেখলাম; একজন বিদেশী যুবা
তোমাকে ক্যামোন জোর করে টেনে নিচ্ছে—
তুমি নিরুপায়!
হয়তো তোমার বিশ্বাস ছিল
তোমার ভালবাসার প্রতিদানে
আমি তোমাকে উদ্ধার করবো। আমি তাই করেছ
আমি তোমার জন্যে মুক্তিযুদ্ধে গেছি
মর্টার ধরেছি, দাঁত দিয়ে গ্রেনেডের ক্লিপ ছিঁড়েছি—
দ্যাখো, তার সঠিক ফলাফল পাওয়া গেছে
একটি চরম যুদ্ধে।
অতএব এসো, এখন জ্বলজ্বলে দিনের আলোয় পুনর্মিলন হোক
আমাদের–
যেহেতু আমি তোমার আশৈশব প্রেমিক—
তোমার ভালবাসা আমার শরীরে!