রবিবার, ১০ মে, ২০২০

তসলিমা নাসরিন

পারো তো ধর্ষণ করো


আর ধর্ষিতা হয়ো না, আর না
আর যেন কোনও দুঃসংবাদ কোথাও না শুনি যে তোমাকে ধর্ষণ করেছে
কোনও এক হারামজাদা বা কোনও হারামজাদার দল।
আমি আর দেখতে চাই না একটি ধর্ষিতারও কাতর করুণ মুখ,
আর দেখতে চাই না পুরুষের পত্রিকায় পুরুষ সাংবাদিকের লেখা সংবাদ
পড়তে পড়তে কোনও পুরুষ পাঠকের আরও একবার মনে মনে ধর্ষণ করা ধর্ষিতাকে।
ধর্ষিতা হয়ো না, বরং ধর্ষণ করতে আসা পুরুষের পুরুষাঙ্গ কেটে ধরিয়ে দাও হাতে,
অথবা ঝুলিয়ে দাও গলায়,
খোকারা এখন চুষতে থাক যার যার দিগ্বিজয়ী অঙ্গ, চুষতে থাক নিরূপায় ঝুলে থাকা
অণ্ডকোষ, গিলতে থাক এসবের রস, কষ।
ধর্ষিতা হয়ো না,পারো তো পুরুষকে পদানত করো, পরাভূত করো,
পতিত করো, পয়মাল করো
পারো তো ধর্ষণ করো,
পারো তো ওদের পুরুষত্ব নষ্ট করো।
লোকে বলবে, ছি ছি, বলুক।
লোকে বলবে এমন কী নির্যাতিতা নারীরাও যে তুমি তো মন্দ পুরুষের মতই,
বলুক, বলুক যে এ তো কোনও সমাধান নয়, বলুক যে তুমি তো তবে ভালো নও
বলুক, কিছুতে কান দিও না, তোমার ভালো হওয়ার দরকার নেই,
শত সহস্র বছর তুমি ভালো ছিলে মেয়ে, এবার একটু মন্দ হও।

চলো সবাই মিলে আমরা মন্দ হই,
মন্দ হওয়ার মত ভালো আর কী আছে কোথায়!

নষ্ট মেয়ে


ওরা কারো কথায় কান দেয় না, যা ইচ্ছে তাই করে,
কারও আদেশ উপদেশের তোয়াককা করে না,
গলা ফাটিয়ে হাসে, চেঁচায়, যাকে তাকে ধমক দেয়
নীতি রীতির বালাই নেই, সবাই একদিকে যায়, ওরা যায় উল্টোদিকে
একদম পাগল!
কাউকে পছন্দ হচ্ছে তো চুমু খাচ্ছে, পছন্দ হচ্ছে না, লাত্থি দিচ্ছে
লোকে কি বলবে না বলবে তার দিকে মোটেও তাকাচ্ছে না।
ওদের দিকে লোকে থুতু ছোড়ে, পেচ্ছাব করে
ওদের ছায়াও কেউ মাড়ায় না, ভদ্রলোকেরা তো দৌড়ে পালায়।
নষ্ট মেয়েদের মাথায় ঘিলু বলতেই নেই, সমুদ্রে যাচ্ছে, অথচ ঝড় হয় না তুফান হয়
একবারও আকাশটা দেখে নিচ্ছে না।
ওরা এরকমই, কিছুকে পরোয়া করে না
গভীর অরণ্যে ঢুকে যাচ্ছে রাতবিরেতে, চাঁদের দিকেও দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে!

আহ, আমার যে কী ভীষণ ইচ্ছে করে নষ্ট মেয়ে হতে।
নারী-জন্ম


তাদের জন্য আমার করুণা হয় যারা নারী নয় 
দুর্ভাগাদের জন্য আমার দুঃখ হয়, যারা নারী নয়। 
অবিশ্বাস্য এই শিল্প, অতুলনীয় শিল্প এই নারী, বিশ্বের বিস্ময়, বিচিত্রিতা। 
আমি নারী, বারবার চাই, শতবার চাই নারী হতে, নারী হয়ে জন্ম নিতে। সহস্র জন্ম চাই আমি, 
নারী জন্ম চাই। নারীর প্রেম চাই, তার কামরসে স্নান চাই, মৈথুন চাই। 
মৈথুনে মোহাচ্ছত হতে হতে মরিয়া হয়ে চাই একটি শিশু, আমার তীব্র প্রচণ্ড চাওয়া তীব্রতর 
হতে থাকে যতক্ষণ না আমার নারী-শরীরটিই শুক্রাণুর জন্ম দিচ্ছে। 
একটি ভ্রূণ আমার জরায়ুতে। 
নারী-শিশু জন্ম দেব আমি, আমি নারী, জন্ম দেব নারী-শিশু। 
আমি ভালোবাসছি সর্বদর্শী সর্বময়ী সর্বব্যাপিনী শাশ্বতী নারীশক্তি। ভালোবাসছি নারীশিশু, 
কিশোরী, তরুণী, যুবতী, বৃদ্ধা। হিরন্ময়ী ইচ্ছাময়ী প্রাণবতী হৃদয়বতী আবর্তিত 
হতে হতে বিবর্তিত হতে হতে সম্রাজ্ঞী হতে হতে গোটা ব্রম্মাণ্ডের ঈশ্বরী হচ্ছে। 
ভালোবাসছি আমাকে! 
নারীকে। 
নারী-জন্মকে।

ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত


ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
এখনো কেমন যেন হৃদয় টাটায়-
প্রতারক পুরুষেরা এখনো আঙুল ছুঁলে
পাথর শরীর বয়ে ঝরনার জল ঝরে।

এখনো কেমন যেন কল কল শব্দ শুনি
নির্জন বৈশাখে, মাঘ-চৈত্রে-
ভুল প্রেমে কেটে গেছে তিরিশ বসন্ত, তবু
বিশ্বাসের রোদে পুড়ে নিজেকে অঙ্গার করি।

প্রতারক পুরুষেরা একবার ডাকলেই
ভুলে যাই পেছনের সজল ভৈরবী
ভুলে যাই মেঘলা আকাশ, না-ফুরানো দীর্ঘ রাত।
একবার ডাকলেই
সব ভুলে পা বাড়াই নতুন ভুলের দিকে
একবার ভালোবাসলেই
সব ভুলে কেঁদে উঠি অমল বালিকা।

ভুল প্রেমে তিরিশ বছর গেল
সহস্র বছর যাবে আরো,
তবু বোধ হবে না নির্বোধ বালিকার।

চরিত্র


তুমি মেয়ে,
তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো
তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে
লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।
তুমি যখন গলি ধরে হাঁটতে থাকবে
লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।
তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে
লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গাল দেবে।
যদি তুমি অপদার্থ হও
তুমি পিছু ফিরবে
আর তা না হলে
যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।